ইনভার্টার এসি কি? কিভাবে কাজ করে?

2
1114

ধরুন গরম শুরু হবার আগেই আপনি নিজ বাসার জন্য একটি এয়ার কন্ডিশনার কিংবা সংক্ষেপে “এসি” কিনতে চান। সেই কারনে আপনি খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করলেন “কি ধরনের এসি কেনা যায়?” উত্তর হিসাবে জানতে পারলেন দুই রকমের এসি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-

  1. ইনভার্টার এসি এবং অন্যটি হচ্ছে,
  2. নন-ইনভার্টার এসি

এখন আপনি চিন্তিত, কি ধরনের এসি কিনবেন? আজকের আর্টিকেলে আমরা ইনভার্টার এসি নিয়ে আলোচনা করবো যাতে করে এই ধরনের এসি সম্পর্কে ভালো কিছু ধারনা পেতে পারেন যা আপনার জন্য এসি নির্বাচন করতে সহায়ক হবে।

পরিচিতি

আমরা সবাই জানি, প্রযুক্তি নিয়মিত পরিবর্তনশিল এবং ক্রমান্বয়ে এটি আপডেট হচ্ছে। এখন বাজারে যেই ইনভার্টার এসি দেখতে পান সেগুলো হচ্ছে মুলত এয়ার কন্ডিশনার এর সর্বাধুনিক সংস্করণ। ইনভার্টার প্রযুক্তিটিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার মাধ্যমে ৩০-৫০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়। এই ইনভার্টার প্রযুক্তি হচ্ছে মুলত এসির মধ্যে বিদ্যমান কম্প্রেসর এর একটি ধরন যা সর্বপ্রথম জাপানিজ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান তোশিবা তাদের এসির জন্য ব্যবহার করা শুরু করে। অল্প কিছুদিন এর মধ্যেই কাস্টমারদের কাছে ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি অনেক বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং তখন থেকে বিশ্বব্যাপী এই ইনভার্টার এসির ব্যাপকহারে ব্যবহার করা শুরু হয়।

গ্রাহক জনপ্রিয়তার সবথেকে বড় কারন ছিল “বিদ্যুৎ সাশ্রয়”। সাধারন এসি যেই পরিমান বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সেখানে ইনভার্টার প্রযুক্তির ৩০-৫০% কম বিদ্যুৎ শক্তি খরচ করে থাকে যার কারনে, ২০১০ সালে ISO ইনভার্টার এসিকে “Energy Star” এর রেটিং প্রদান করে এবং সেই থেকে পশ্চিমা প্রায় সকল দেশগুলো শুধুমাত্র ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

ইনভার্টার এসি কি?

একটি সহজ উদাহরন দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ধরুন, আপনি গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরতে যাবেন। এই যাত্রাপথে একাধিক স্থানে আপনাকে ট্র্যাফিক কিংবা জ্যাম-জট এর মধ্যে পরতে হবে। যদি ১০ মিনিট কোনও স্থানে ট্র্যাফিক এর মধ্যে বসে থাকতে হয় তাহলে কি করবেন?

  1. গাড়ির ইঞ্জিন ১০ মিনিট এর জন্য বন্ধ করে রাখবেন।
  2. গাড়ির ইঞ্জিন সক্রিয় থাকবে তবে ইঞ্জিন এর শক্তি (accelerator power) থাকবে সীমিত।
যদি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে ট্র্যাফিক সিগন্যালে বসে থাকেন তাহলে সিগন্যাল শেষ হলে আপনার ইঞ্জিনকে পুনরায় চালু করতে হবে এবং এরপর ইঞ্জিন এর শক্তি (accelerator power) বাড়াতে হবে। এই প্রক্রিয়া অনুসরন করে কাজ করে নন-ইনভার্টার এসি। নন-ইনভার্টার এসি সম্পর্কে আমরা অন্য আর একটি আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। অনুগ্রহ করে এই ধরনের এসি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য নন-ইনভার্টার এসি এই আর্টিকেলটি বিস্তারিত পড়ে নিতে পারেন।

ইনভার্টার প্রযুক্তি মুলত কাজ করে অনেকটা গাড়ির ইঞ্জিন এর মতন। অর্থাৎ, এখানে এসির কম্প্রেসর কখনোই বন্ধ হয়না। যখন রুম ঠাণ্ডা করার জন্য কম্প্রেসর এর বেশী শক্তির প্রয়োজন হয় তখন সে বেশী শক্তি গ্রহন করে অন্যদিকে, নির্ধারিত তাপমাত্রায় পোঁছানোর পর কম্প্রেসর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে খুব ধীর-গতিতে কাজ করতে থাকে যার কারনে তখন শক্তির প্রয়োজন হয় অনেক কম।

কিভাবে কাজ করে?

ধরুন রুমের জন্য এসির তাপমাত্রা ঠিক করলেন ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কিংবা সংক্ষেপে “25°C”. যদি আপনার এসি নন-ইনভার্টার হয় তাহলে 25°C আসলেই এসির কন্ট্রোল বোর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্প্রেসর এর শক্তি বন্ধ করে দিবে অর্থাৎ, তখন কম্প্রেসর আর চলবে না। কিছু সময় পর যখন রুমের নির্ধারিত তাপমাত্রা 25°C এর উপরে চলে আসবে তখন পুনরায় কম্প্রেসর চালু হবে। অর্থাৎ, বারবার এভাবেই কম্প্রেসর চালু এবং বন্ধ হতে থাকবে। কম্প্রেসর যখন চালু হবে তখন সে অতিরিক্তি শক্তি ব্যবহার করে থাকে যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ এর অপচয় হয়।

অন্যদিকে, আপনার এসিটি যদি ইনভার্টার প্রযুক্তির হয় তাহলে 25°C গেলে এসির কন্ট্রোল বোর্ড, কম্প্রেসরকে বন্ধ করার পরিবর্তে শক্তি প্রবাহ কমিয়ে দিবে। আবার যখন তাপমাত্রা 25°C এর উপরে চলে আসবে তখন পুনরায় কম্প্রেসরকে শক্তি প্রদান করা হবে। অর্থাৎ, ইনভার্টার প্রযুক্তিতে কম্প্রেসর কখনোই বন্ধ হয়না। যার কারনে বারবার কম্প্রেসর চালু হবার সময় যেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয় সেটি সম্পূর্ণরূপে ইনভার্টার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাশ্রয় করা সম্ভব।

সুবিধাসমুহ

এতক্ষন ইনভার্টার এসি কি এবং কিভাবে এই ধরনের এসি কাজ করে সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন সময় হয়েছে ইনভার্টার এসি ব্যবহারের কিছু সুবিধাসমুহ নিয়ে আলোচনা করার। মুলত এই সুবিধাগুলোর কারনেই দিনদিন এই ধরনের এসির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

  • শক্তির অপচয় রোধ: ইনভার্টার প্রজুক্তির এসিতে কম্প্রেসর বারবার চালু কিংবা বন্ধ হয় না যার কারনে, কম্প্রেসর চালু কিংবা বন্ধ হবার সময় বিদ্যুত শক্তির উপরে অতিরিক্ত কোনও চাপ পড়েনা। ক্রমশ কম্প্রেসর চালু কিংবা বন্ধ হবার কারনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয় যা ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি ব্যবহার করে সম্পূর্ণরূপে শক্তির এই অপচয় রোধ করা সম্ভব। এছাড়াও ইনভার্টার এসি ব্যবহার করে বছরে প্রায় ৪০-৫০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব।
  • কম খরচ: যেহেতু ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি তুলনামূলক কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এই কারনে এটির ব্যবহারে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেহেতু অন্য এসির তুলনায় ইনভার্টার এসি বছরে প্রায় ৪০-৫০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারে তাই আপনার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল এর ঝামেলাও বহন করতে হবেনা।
  • দ্রুত ঠাণ্ডা: অনেকসময় বিভিন্ন এসির ফিচার হিসাবে “Rapid Cooling” কথাটি দেখতে পাবেন। এটির অর্থ হচ্ছে, ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি অন্য এসির তুলনায় দ্রুততার সাথে রুম ঠাণ্ডা করতে সক্ষম। যেহেতু ইনভার্ট প্রযুক্তির এসিতে কম্প্রেসর কখনোই বন্ধ হয়না এর কারনে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার সময় লাগে অনেক কম। অর্থাৎ, গরমের দিনে বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হতে হতেই এই এসি আপনার রুম ঠাণ্ডা করতে সক্ষম।
  • শব্দমুক্ত অপারেশন: কম্প্রেসর যখন চালু হয় তখন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন এবং এর ফলে কিছুটা শব্দের উৎপত্তিও হয়ে থাকে। এখন যদি বারবার কম্প্রেসর চালু এবং বন্ধ হতে থাকে তাহলে এই শব্দের পরিমানও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। যা অনেকসময় আপনার জন্য বিরক্তির কারনও হতে পারে। অন্যদিকে, ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির কম্প্রেসর কখনোই বন্ধ হয় না এবং এটি অল্প পরিমানের বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে কাজ করতে থাকে যার কারনে কোনও শব্ধ নির্গত হয় না ।
  • অন্যান্য সুবিধা: “Renewal Energy” কিংবা যদি বাংলা করে বলি “নবায়নযোগ্য শক্তি” যেমন ধরুন, সোলার সিস্টেম। আমাদের দেশে ব্যাপক আকারের এই ধরনের শক্তির ব্যবহার না হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে সোলার সিস্টেম এর ব্যবহার অনেক বেশী। যেহেতু ইনভার্টার এসি চালনা বিদ্যুৎ শক্তি তুলনামূলক কম প্রয়োজন হয় এই কারনে এই প্রযুক্তির এসিকে আপনি চাইলে “সৌরশক্তির” মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়াও, এই প্রযুক্তির এসিতে যেই ধরনের গ্যাস কিংবা রেফ্রিজারেন্ট ব্যবহৃত হয় সেটি পরিবেশের ক্ষতি করেনা এবং সবথেকে বড় সুবিধা হচ্ছে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল এর চাপ থেকে মুক্তি।

অসুবিধাসমুহ

ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির ব্যবহারে কিছু বিড়ম্বনাও রয়েছে। এতক্ষণ আপনাদের সাথে সুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন সময় হয়েছে এই প্রযুক্তির এসির কিছু অসুবিধা সম্পর্কেও জেনে নেয়ার।

  • খারাপ মানের ইন্স্যুলেশন এর কারনে খরচ বৃদ্ধি: ইনভার্টার এসি তখনই ভালো কাজ করবে যদি আপনার রুমের ইন্স্যুলেশন সিস্টেম ভাল থাকে। যেমন, রুমের দরজা-জানালা যদি ভালো করে বন্ধ করা না থাকে কিংবা বন্ধ করার পরও যদি বাইরের বাতাস ঢোকার মতন অবস্থা থাকে তাহলে কম্প্রেসর বেশী পরিমান বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে, বিদ্যুৎ বিল এর পরিমানও বাড়তে থাকবে।
  • রিপেয়ার এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশী: ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির মধ্যে যেসকল যন্ত্রাদি (Component) ব্যবহৃত হয় সেগুলো ব্যায়বহুল। যদি কোনও কারনে এই যন্ত্রাদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেগুলোর রেপারিং এর জন্য ভাল পরিমান অর্থ খরচ করতে হবে। ইনভার্টার এসি ক্রয় করার পূর্বে অবশ্যই এই খরচ এর বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ থাকবে।
  • ব্যায়বহুল: ইনভার্টার এসির সবথেকে বড় অসুবিধা হচ্ছে এর মুল্য। সাধারণ এসির তুলনায় এর এসির মুল্য অনেক বেশী। যেহেতু ইনভার্টার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত এসির যন্ত্রাংশ কিছুটা ব্যায়বহুল তাই এটি ক্রয় করতে হয়। ব্র্যান্ড ভেদে, সাধারণ এসির তুলনায় এই এসির মুল্য ৫০-৭০% পর্যন্ত বেশী হয়ে থাকে। সুতরাং, যাদের বাজেট কম তাদের জন্য ইনভার্টার এসি সুবিধাজনক নয়।

ইনভার্টার প্রযুক্তির বয়স খুব বেশী দিন হয়নি যার কারনে এই প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত যন্ত্রাংশের মুল্য এখন পর্যন্ত বেশী। তাই এই ধরনের এসির জন্য কাস্টমারকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়। তবে যেহেতু প্রযুক্তি দিনদিন আপডেট হচ্ছে সুতরাং, হয়তোবা ভবিষ্যতে এর মুল্য খানিকটা কমে আসতে পারে। তবে বিশ্বায়নের এই সময়ে আমরা সবাই পরিবেশ নিয়ে অনেকটাই সচেতন যার কারনে ইনভার্টার প্রযুক্তির ব্যবহারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যাদের বাজেট কম তারা চাইলে নন-ইনভার্টার (সাধারণ প্রযুক্তির) এসি ব্যবহার করতে পারেন। এই ধরনের এসির সবথেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, এটির মুল্য তুলনামূলক অনেক কম এবং এই ধরনের এসির রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম। যদি সাধারণ প্রযুক্তির এই এসি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে “নন-ইনভার্টার এসি কি? কিভাবে কাজ করে?” এই আর্টিকেলটি পড়ে দেখার অনুরোধ থাকছে।

আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভাল লেগেছে। যদি এই আর্টিকেল সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন কিংবা মতামত জানাতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে নিচের কমেন্ট সেকশনে সেটি জানাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে সর্বাত্মক সহায়তা করার।

2 COMMENTS

কমেন্ট সেকশন

Please enter your comment!
Please enter your name here