নিজ বাসা কিংবা অফিসের জন্য যখন আপনি এয়ার কন্ডিশনার কিংবা এসি ব্যবহার করতে চাইবেন তখন আপনার সামনে দুইটি নাম সামনে আসবে ইনভার্টার কিংবা নন-ইনভার্টার এসি। এখন যদি আসন্য গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে নিজেকে শান্তি প্রদান করতে চান তাহলে এসি কোনও বিকল্প অপশন নেই এবং এই কারনে প্রতিবছর মিলিয়ন ইউনিট এর উপরে এসি বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়।
কাজের ধরন অনুসারে এসিকে মুলত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায় –
- ইনভার্টার এসি
- নন-ইনভার্টার এসি
আমরা ইতিমধ্যেই ইনভার্টার এসি নিয়ে আপনাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যারা এই ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি ব্যবহার করতে আগ্রহী তারা চাইলে “ইনভার্টার এসি কি এবং বিস্তারিত” এই আর্টিকেলটি ভাল করে পড়ে নিতে পারেন। তাহলে আশা করছি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নন-ইনভার্ট এসি সম্পর্কে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
পরিচিতি
এসি মুলত যেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঠাণ্ডা বাতাস প্রদান করতে সক্ষম, সেটি কিন্তু খুব বেশী পুরাতন নয়।প্রখ্যাত আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার Willis Haviland Carrier, ১৯০২ সালে আমেরিকার ব্রুকলিনে অবস্থিত একটি ছাপাখানায় (printing press) বাতাসের আদ্রতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথম এই এসি আবিষ্কার করেন।
সেই সময়ে Willis Carrier যেই প্রযুক্তির মাধ্যমে এসি আবিষ্কার করেছিলেন সেটিই হচ্ছে আজকের নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির এসি। অর্থাৎ, সেই সময় থেকে আজ-অবধি আমরা যেই এসি ব্যবহার করছি তাদের কাজ করার প্রক্রিয়া একই রকমের।
তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কারনে নিত্যনতুন ফিচার যুক্ত হয়েছে যা এসিকে করেছে আরও আকর্ষণীয় এবং ব্যবহারউপযোগী। আজকের নন-ইনভার্টার এসির বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বের প্রথমে জেনে নিতে হবে এই প্রযুক্তির এসি কিভাবে মুলত কাজ করে।
নন-ইনভার্টার এসি কি?
এসির মধ্যে বিদ্যমান যেই যন্ত্রাংশগুলোর মধ্যে যেটি শীতলীকরণ কাজে সবথেকে বড় ভূমিকা রাখে সেটি হচ্ছে “কমপ্রেসর”। ইনভার্টার কিংবা নন-ইনভার্টার মুলত এসিতে বিদ্যমান এই কমপ্রেসর এর একটি বিশেষ ধরন।
কমপ্রেসর কি এবং এর কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার থাকলে আমাদের ব্লগে কমপ্রেসর এর বিস্তারিত আর্টিকেলটি পড়ে নিতে পারেন।
একটি সহজ উধাহরন দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি। ধরুন, আপনি গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরতে যাবেন। এই যাত্রাপথে একাধিক স্থানে আপনাকে ট্র্যাফিক কিংবা জ্যাম-জট এর মধ্যে পরতে হবে। যদি ২০ মিনিট কোনও স্থানে ট্র্যাফিক এর মধ্যে বসে থাকতে হয় তাহলে কি করবেন?
- গাড়ির ইঞ্জিন ২০ মিনিট এর জন্য বন্ধ করে রাখবেন।
- গাড়ির ইঞ্জিন সক্রিয় থাকবে তবে ইঞ্জিন এর শক্তি (accelerator power) থাকবে সীমিত।
যদি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে ট্র্যাফিক সিগন্যালে বসে থাকেন তাহলে সিগন্যাল শেষ হলে আপনার ইঞ্জিনকে পুনরায় চালু করতে হবে এবং এরপর ইঞ্জিন এর শক্তি (accelerator power) বাড়াতে হবে। মুলত এই প্রক্রিয়া অনুসরন করে কাজ করে নন-ইনভার্টার এসি।
নন-ইনভার্টার প্রযুক্তি মুলত কাজ করে অনেকটা গাড়ির ইঞ্জিন এর মতন। অর্থাৎ, এখানে এসির কম্প্রেসর একটি নির্দিষ্ট সময় (তাপমাত্রা হিসাবে) চালু এবং বন্ধ হয়। যখন রুম ঠাণ্ডা করার জন্য আপনি এসি চালু করেন তখন কম্প্রেসর শক্তি গ্রহন করে সেই কাজটি সম্পন্ন করতে থাকে। কিছুটা সময় পর যখন রুমের তাপমাত্রা আপনার নির্ধারিত লেভেলে পৌছায় তখন, এসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমপ্রেসর এর শক্তি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়।
অর্থাৎ, তাপমাত্রার লেভেল বিবেচনা করে কমপ্রেসর বারবার চালু এবং বন্ধ হতে থাকে। এটিই হচ্ছে মুলত নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির কাজ করার পদ্ধতি।
কিভাবে কাজ করে?
ধরুন রুমের জন্য এসির তাপমাত্রা ঠিক করলেন ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস কিংবা সংক্ষেপে “25°C”. যদি আপনার এসি নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির হয় তাহলে, রুমের তাপমাত্রা যখন 25°C লেভেল চলে আসবে তখনই এসির কন্ট্রোল বোর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্প্রেসর এর শক্তি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দিবে অর্থাৎ, তখন কম্প্রেসর আর চলবে না।
কিছু সময় পর, যখন রুমের নির্ধারিত তাপমাত্রা 25°C এর উপরে চলে আসবে তখন পুনরায় কম্প্রেসর চালু হবে। অর্থাৎ, বারবার এভাবেই কম্প্রেসার চালু এবং বন্ধ হতে থাকবে। উপরের ছবিটি যদি মনোযোগ সহকারে দেখেন তাহলে নন-ইনভার্টার প্রযুক্তিতে এসি কিভাবে কাজ করে সেটির কিছুটা ধারনা পাবেন।
সুবিধাসমূহ
এতক্ষন নন-ইনভার্টার এসি কি এবং কিভাবে এই ধরনের এসি কাজ করে সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখন সময় হয়েছে নন-ইনভার্টার এসি ব্যবহারের কিছু সুবিধাসমুহ নিয়ে আলোচনা করার। মুলত এই সুবিধাগুলোর কারনে এখন পর্যন্ত নন-ইনভার্টার এসি বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয়।
- সাশ্রয়ী মুল্য: নন-ইনভার্টার প্রজুক্তির এসির মুল্য অপেক্ষাকৃত অনেক কম। যদি ইনভার্টার এসির মুল্যের সাথে তুলনা করি তাহলে প্রায় ৩০-৪০% কম অর্থ ব্যায় হবে। মুলত এই এসিগুলোর মুল্য কম হবার কারনেই এখন পর্যন্ত নন-ইনভার্টার এসিগুলোর প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা থাকে অনেক বেশী।
- রিপেয়ার এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক কম: নন-ইনভার্টার এসিতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ অনেক বেশী সহজলভ্য হবার কারনে ভবিষ্যৎ রিপেয়ারিং এর জন্য খরচ অনেক কম হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের সার্কিট, ক্যাপাসিটর, কম্প্রেসার এর মুল্য নন-ইনভার্টার এসির তুলনায় দামে অনেক কম হবার কারনে অতিরিক্ত খরচ নিয়ে তেমন চিন্তা করতে হবেনা।
- অপেক্ষাকৃত বেশী ডিজাইন এবং অপশন: নন-ইনভার্টার এসি যেহেতু এসির প্রযুক্তি গুলোর মধ্যে সবথেকে প্রাচীন তাই বেশীরভাগ ব্র্যান্ডগুলোই সবথেকে বেশী পরিমান নন-ইনভার্টার এসি উৎপাদন করে থাকে। এছাড়াও, সহজলভ্য হবার কারনে গ্রাহকের চাহিদাও অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী থাকে যার কারনে মার্কেটে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন ডিজাইন পাওয়া যায় যা আপনার পছন্দের সাথে মিলে যাবে অবশ্যই।
অসুবিধাসমুহ
নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির ব্যবহারে কিছু বিড়ম্বনাও রয়েছে। এতক্ষণ আপনাদের সাথে সুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন সময় হয়েছে এই প্রযুক্তির এসির কিছু অসুবিধা সম্পর্কেও জেনে নেয়ার।
- শক্তির অপচয়: নন-ইনভার্টার প্রজুক্তির এসিতে কম্প্রেসর বারবার চালু এবং বন্ধ হয় যার কারনে, কম্প্রেসর চালু কিংবা বন্ধ হবার সময় বিদ্যুৎ শক্তির উপরে অতিরিক্ত চাপ পরে। ক্রমশ কম্প্রেসর চালু কিংবা বন্ধ হবার কারনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয় যার প্রভাব পড়বে সরাসরি আপনার মাসিক বিদ্যুৎ বিল এর উপর।
- শব্দযুক্ত অপারেশন: কম্প্রেসর যখন চালু হয় তখন অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন এবং এর ফলে কিছুটা শব্দের উৎপত্তিও হয়ে থাকে। এখন যদি বারবার কম্প্রেসর চালু এবং বন্ধ হতে থাকে তাহলে এই শব্দের পরিমানও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। যা অনেকসময় আপনার জন্য বিরক্তির কারনও হতে পারে।
- অন্যান্য অসুবিধা: “Renewal Energy” কিংবা যদি বাংলা করে বলি “নবায়নযোগ্য শক্তি” যেমন ধরুন, সোলার সিস্টেম। আমাদের দেশে ব্যাপক আকারের এই ধরনের শক্তির ব্যবহার না হলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে সোলার সিস্টেম এর ব্যবহার অনেক বেশী। যেহেতু নন-ইনভার্টার এসি চালনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয় এই কারনে এই প্রযুক্তির এসিকে আপনি চাইলে “সৌরশক্তির” মাধ্যমে ব্যবহার করার কোনও সুযোগ নেই।
এতক্ষন পর্যন্ত আমরা নন-ইনভার্টার এসির বিস্তারিত এবং এর সুবিধা-অসুবিধাসমূহ নিয়ে আলোচনা করেছি। আপনার মনে হতে পারে তাহলে এই এসির সুবিধার থেকে অনুবিধাই বেশী! তাহলে এই প্রযুক্তির এসির চাহিদা কেন এত বেশী?
বিদ্যুৎ বিল এর হিসাবটিকে যদি আমরা দূরে সরিয়ে রাখি তাহলে এবার চিন্তা করে বলেন, ইনভার্টার এসি কেমন? এই প্রযুক্তির এসির ক্রয়কৃত মুল্য, ইনভার্টার এসির তুলনায় অনেক কম যার কারনে এই এসির চাহিদাও থাকে সবথেকে বেশী। এছাড়াও, এসির মধ্যে বিদ্যমান যন্ত্রাংশগুলো অনেকবেশী পরিমান সহজলভ্য যার কারনে ভবিষ্যৎ রিপেয়ারিং এর খরচও হবে অনেক কম।
ইনভার্টার এবং নন-ইনভার্টার এসির মধ্যকার সুবিধা-অসুবিধা গুলোকে আমরা পাশাপাশি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছি অন্য একটি আর্টিকেলে। আপনি যদি এখনও নিশ্চিত হতে না পারেন কোনও ধরনের এসিটি আপনার জন্য ভাল হবে তাহলে এখন সময় হয়েছে “ইনভার্টার এবং নন-ইনভার্টার এসির পার্থক্য কি?” সম্পর্কে জানার। অনুগ্রহ করে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য এই লিংক ক্লিক করে আর্টিকেলটি পড়ে নিন।
আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভাল লেগেছে। যদি এই আর্টিকেল সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন কিংবা মতামত জানাতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে নিচের কমেন্ট সেকশনে সেটি জানাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে সর্বাত্মক সহায়তা করার।
[…] নন-ইনভার্টার এসি […]