ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তি

2
510
Digital Inverter Technology

রেফ্রিজারেশন কিংবা শীতলীকরণ কাজে ব্যবহৃত যেসকল এপ্লায়েন্সগুলো আছে তাদের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এই সকল রেফ্রিজারেশন এপ্লায়েন্স এর মধ্যে, সবথেকে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনার কিংবা সংক্ষেপে এসি।

খাবার সংরক্ষণ কিংবা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য ফ্রিজ এবং তীব্র গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসি আমাদের জীবনের অপরিহার্য দুইটি বস্তু। এই দুইটি বস্তুই কিন্তু রেফ্রিজারেশন কাজের সাথে যুক্ত এবং এতে ব্যবহৃত কমপ্রেসর হচ্ছে এদের হৃদপিণ্ড কিংবা হার্ট।

যদি আমার এভাবে বিষয়টি চিন্তা করি, মানুষের শরীরকে চালনা করে হৃদপিণ্ড যেটি হার্ট নামেই সবথেকে বেশী পরিচিত। ঠিক তেমনই রেফ্রিজারেশন এপ্লায়েন্স (যন্ত্র) গুলোর ক্ষেত্রে কমপ্রেসর হচ্ছে এটির হৃদপিণ্ড কিংবা হার্ট।

রেফ্রিজারেশন সিস্টেম কি?

রেফ্রিজারেশন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যেটি ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অর্থাৎ, এই নির্দিষ্ট স্থানে তাপমাত্রা সবসময়ই শীতল কিংবা ঠাণ্ডা থাকবে। যেমন, খাবার সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজের অভ্যন্তরের তাপমাত্রা সবসময় ঠাণ্ডা থাকে কিংবা গরমের থেকে বাঁচার জন্য যখন রুমে এসি ব্যবহার করা হয় তখন সেই এসির রুমের তাপমাত্রাকে ঠাণ্ডা করে রাখে।

যেই মাধ্যম ব্যবহার করে নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রাকে বাহিরের তাপমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ঠাণ্ডা করে রাখা হয় সেই প্রক্রিয়া করে বলা হয় রেফ্রিজারেশন সিস্টেম কিংবা পদ্ধতি।

যদি উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে ধরে নিন, রাজধানী ঢাকার আজকের তাপমাত্রা হচ্ছে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন আপনার রুমের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যদি এসি ব্যবহার করেন তাহলে এই এয়ার কন্ডিশনার তখন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম ব্যবহার করে আপনার রুমের তাপমাত্রাকে বাহিরের ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর থেকে কমিয়ে ২০ কিংবা ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

রেফ্রিজারেশন সিস্টেম নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করবো অন্য কোনও আর্টিকেলে। এখন পর্যন্ত এইটুকু মনে রাখুন, রেফ্রিজারেশন প্রক্রিয়ায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে কমপ্রেসর।

ডিজিটাল ইনভার্টার কমপ্রেসর

রেফিরেজারেশন সিস্টেম এর ইতিহাস অনেক পুরাতন হলেও এর মধ্যে ব্যবহৃত কমপ্রেসর এর ব্যবহার খুব বেশী পুরাতন নয়। ১৯০২ সালে রেফ্রিজারেশন পদ্ধতিতে কমপ্রেসর এর ব্যবহার শুরু হবার পর থেকে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এতে নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসকল ফ্রিজ কিংবা এসি ব্যবহার করে থাকি প্রাথমিক যুগে এগুলোতে মুলত ব্যবহার হতো নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসর যা এখনও বিদ্যমান তবে বিশ্বায়নের যুগে রেফ্রিজারেশন পদ্ধতির মধ্যে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এর কারনে এতে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে ইনভার্টার প্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের কমপ্রেসর যা অধিকতর কার্যকরী এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে সক্ষম।

ইনভার্টার প্রযুক্তির এই কম্প্রেসরের একটি আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসর যা পূর্বের উদ্ভাবিত ইনভার্টার কমপ্রেসর এর তুলনায় অনেক বেশী কার্যকরী এবং স্থায়িত্তের বিবেচনায় শক্তিশালী।

আমারা ইতিমধ্যেই বেশকিছু ধরনের ইনভার্টার এবং নন ইনভার্টার প্রযুক্তি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আর্টিকেলে আলোচনা করেছি। আপনি চাইলে নিচের আর্টিকেলগুলোকে রেফারেন্স হিসাবে পড়ে নিতে পারেন। –

ডিজিটাল ইনভার্টার কমপ্রেসর এর কাঠামো

ইনভার্টার প্রযুক্তি সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আপনি বেশকিছু ধারনা পেয়েছেন আশা করছি। ডিজিটাল-ইনভার্টার প্রযুক্তি হচ্ছে মুলত সাধারণ ইনভার্টার প্রযুক্তির কিছুটা আপডেট সংস্করণ। সাধারণ ইনভার্টার কমপ্রেসর এবং ডিজিটাল ইনভার্টার কমপ্রেসর এর মধ্যকার পার্থক্য হচ্ছে মুলত এতে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক মোটরে।

ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরে যেই ধরনের ইলেকট্রিক মোটর ব্যবহার করা হয় সেটি হয় মুলত ৪-পোলের। অন্যদিকে, ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরগুলোতে ব্যবহৃত হয় ৮-পোলের ইলেকট্রিক মোটর।

এখন আপনার মনে প্রশ্ন হতে পারে, মোটরে ব্যবহৃত এই পোল (Pole) বলতে কি বোঝায়? আপনি হয়ত নিশ্চয় জানেন, ইলেকট্রিক মোটর এর মধ্যে থাকে ম্যাগনেট কিংবা বাংলাতে যদি বলি তাহলে চৌম্বক। এই ম্যাগনেটগুলো, মোটর এর মধ্যে বিদ্যমান শ্যাফট এর চারপাশে বসানো থাকে।

৪ পোলের মোটর এর অর্থ হচ্ছে এর মধ্যে থাকে ৪টি ম্যাগনেট অন্যদিকে, ৮ পোলের মোটর এর অর্থ হচ্ছে এর মধ্যে ৮ টি ম্যাগনেট কিংবা চৌম্বক বিদ্যমান থাকে। এই ম্যাগনেট কিংবা চৌম্বক এর আকর্ষণ এর কারনে মোটরের মধ্যে থাকা শ্যাফট ঘুরতে থাকে।

ধরা যাক,ডুয়েল ইনভারর্টার কম্প্রেসরে ৪ পোল আর্মেচার ২ টি ব্যবহার হয়েছে যেখানে, ডিজিটাল ইনভারর্টার প্রযুক্তির কম্প্রেসরে ৮ পোল আর্মেচার ১ টি ব্যবহার হয়েছে। এখানে দুইটি ৪ পোল আর্মেচারের জন্য যে পরিমান বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হবে সে তুলনায় একটি ৮ পোল আর্মেচারের কম্প্রেসরে কম পরিমানে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহৃত হবে। কারন সমপরিমান ঠান্ডার জন্য একটি ৮ পোল আর্মেচারের মাধ্যমে দুইটি ৪ পোল আর্মেচারের কাজ করা হচ্ছে।

এতক্ষন আপনাদের সাথে ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরের কাঠামো এবং কারগরি দিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। যেহেতু এটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি তাই সাধারণ ইনভার্টার কমপ্রেসর এর থেকে এটি ব্যবহারে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা রয়েছে। তাহলে চলুন এবার সেগুলো জেনে নেয়া যাক।

ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য

২০১৯ সালে বিখ্যাত কোরিয়ান ব্র্যান্ড স্যামসাং নিজেদের বিভিন্ন রেফ্রিজারেশন এপ্লায়েন্স যেমন ফ্রিজ এবং এসিতে এই কমপ্রেসর এর ব্যবহার শুরু করে। ধরে নেয়া হয়, স্যামসাং ই হচ্ছে এই ডিজিটাল ইনভার্টার কম্প্রেসরের জনক।

কার্যকারিতা

সাধারণ ইনভার্টার কমপ্রেসরের তুলনায় ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসর গুলো পারফর্মেন্স এর দিকে অনেক বেশী শক্তিশালী। এই কমপ্রেসরগুলো অপেক্ষাকৃত দ্রুততার সাথে প্রয়োজন অনুসারে তাৎক্ষনিক রেসপন্স করার মাধ্যমে শীতলীকরণ কাজ করে থাকে। যেমন যদি এসির কথা চিন্তা করি তাহলে যখন রুমের তাপমাত্রা বেশী থাকে তখন, রুমের তাপমাত্রা বিবেচনায় তাৎক্ষনিক কমপ্রেসর নিজের গতিকে বাড়িয়ে শীতলীকরণ কাজ করতে থাকে। এতে করে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে রুমের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিদ্যুৎ সাশ্রয়

ডুয়েল-ইনভার্টার কমপ্রেসর এর তুলনায়ও ডিজিটাল কমপ্রেসর অপেক্ষাকৃত কম বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে রেফ্রিজারেশন এর কাজ সম্পন্ন করে। এই কমপ্রেসরের মধ্যে ৮ পোলের ব্রাশলেস ডিসি কারেন্ট মোটর (BLDC) থাকার কারনে অতিরক্তি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে না এবং যেহেতু এই ইনভার্টার নিজের কাজ করার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাই প্রয়োজন ছাড়া বিদ্যুৎ শক্তিও ব্যবহার করেনা। এতে করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় যার ফলে বিদ্যুৎ বিলও আসে তুলনামূলক কম।

স্থায়িত্ব

ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরগুলো স্থায়িত্ব হয় অনেক বেশী। ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরগুলো স্থায়িত্ব হয় অনেক বেশী। ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরগুলো স্থায়িত্ব হয় অনেক বেশী। স্যামসাং এর উৎপাদিত কমপ্রেসরগুলোকে জার্মান সার্টিফাইড অথোরিটি VDE (Verband Deutscher Elektrotechnicker) ১২০ দিন ধরে প্রায় ৩০০,০০০ বার পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হয়েছে। যেখানে স্থায়িত্ব হিসাবে বলা হয়েছে প্রায় ২১ বছর পর্যন্ত এই কমপ্রেসরগুলো সফলভাবে কাজ করতে সক্ষম। সুতরাং, এই কমপ্রেসরের এসি কিংবা ফ্রিজগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত সেবা প্রদানে সক্ষম।

যেহেতু এই প্রযুক্তিটি সম্পূর্ণ নতুন তাই এখন পর্যন্ত ডিজিটাল ইনভার্টার প্রযুক্তির কমপ্রেসরগুলো রেফ্রিজারেশন এপ্লায়েন্সগুলোতে খুব বেশী ব্যবহার হয়না। কোরিয়ান ব্র্যান্ড স্যামসাং শুধুমাত্র তাদের নির্দিষ্ট কিছু ফ্রিজ এবং এসিতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে। তবে খুব শীঘ্রই হয়তোবা আমাদের দেশেও ব্যাপক আকারে এই কমপ্রেসর ব্যবহৃত এপ্লায়েন্সগুলো দেখতে পাবো।


আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভাল লেগেছে। যদি এই আর্টিকেল সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন কিংবা মতামত জানাতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে নিচের কমেন্ট সেকশনে সেটি জানাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে সর্বাত্মক সহায়তা করার।

2 COMMENTS

  1. আসসালামু আলাইকুম, আমার একটি মার্সেল কোম্পানির ফ্রিজ আছে, বিদ্যুৎ বিল অনেক আসে, তাই আমি এটাতে ডিজিটাল ইনভার্টার লাগাতে চাই, পাওয়া যাবে কিনা এবং লাগানো যাবে কিনা? জানালে খুব খুশি হবো।

    • কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সেটি সম্ভব নয়। কেননা, ডিজিটাল ইনভার্টার প্রজুক্তির কমপ্রেসর এর সাথে একটি কন্ট্রোলার বোর্ড থাকে যেটি শুধুমাত্র সেই কমপ্রেসরের সাথেই কাজ করে। এই কন্ট্রোলার প্রসেসর এবং কমপ্রেসর এর সমন্বিত ফলাফলই হচ্ছে ডিজিটাল কমপ্রেসর। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

কমেন্ট সেকশন

Please enter your comment!
Please enter your name here