আপনি কি এয়ার কন্ডিশনার কিংবা এসি কেনার কথা চিন্তা করছেন? তাহলে কোন ধরনের এসি কিনবেন? কোনও ধরনের এসি আপনার ব্যবহার করার জন্য ভালো হবে? কোন ধরনের এসি আপনার জন্য সাশ্রয়ী হবে? এই প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই আপনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে!
আমরা ইতিমধ্যেই দুই ধরনের এসি সম্পর্কে বিস্তারিত আপনাদের সাথে আলোচনা করেছি এবং এদের প্রতিটির সুবিধা-অসুবিধাগুলো আপনাদের সামনে উপস্থাপন করেছি। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুই ধরনের এসির মধ্যে কোনটি আপনার জন্য ভালো হবে?
উত্তরটি বিশ্লেষণ করার পূর্বে অবশ্যই নিচের এই দুইটি আর্টিকেল পড়ে নিবেন। এতে করে অনেক বিষয় আপনার পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আজকের আর্টিকেলটিতে আমরা ইনভার্টার এবং নন-ইনভার্টার এসির গুলোর কিছু পার্থক্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো এবং সেই সাথে প্রয়োজন অনুসারে কোন ধরনের এসি আপনার জন্য ভাল হবে সেটি জানার চেষ্টা করবো। তাহলে চলুন শুরু করা যাক!
ইনভার্টার এবং নন-ইনভার্টার এসির পার্থক্য
আর্টিকেলটি কিছুটা বড় যার কারনে নিচে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটির একটি সারমর্ম প্রদান করার চেষ্টা করেছি। এতে করে একনজের বুঝতে পারবেন দুইটি এসির মধ্যকার পার্থক্য। চিন্তার কিছু নেই, প্রতিটি বিষয় নিয়েই আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বৈশিষ্ট্য | ইনভার্টার এসি | নন-ইনভার্টার এসি |
---|---|---|
ক্রয়মুল্য | অপেক্ষাকৃত বেশী | অপেক্ষাকৃত কম |
বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার | তুলনামূলক কম | তুলনামূলক বেশী |
শীতলীকরণ শক্তি | তুলনামূলক কম | তুলনামূলক বেশী |
রিপেয়ারিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ | খরচ বেশী | খরচ কম |
যন্ত্রাংশ | সহজলভ্য নয় | সহজলভ্য |
মাসিক বিদ্যুৎ বিল | কিছুটা কম | কিছুটা বেশী |
উপরের এই বক্স থেকে নিশ্চয় কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন, দুইজনের সুবিধা-অসুবিধা কিন্তু খবই কাছাকাছি।
ক্রয়মুল্য:
দুই ধরনের এসির মধ্যে ইনভার্টার এসির মুল্য তুলনামূলকভাবে বেশী। ব্র্যান্ড ভেধে যদি নন-ইনভার্টার এর সাথে তুলনা করেন তাহলে সেটির পরিমান দাঁড়াবে ৩০-৬০% পর্যন্ত। বেশী দামের হবার কারনে
অনেকেই ইনভার্টার এসি ব্যবহারে খুব বেশী উৎসাহী থাকেননা। কেননা, এক সাথে এতগুলো টাকা খরচ করা সবার পক্ষে সম্ভবও হয়না। মুলত এটিই হচ্ছে ইনভার্টার প্রযুক্তির সবথেকে বড় অসুবিধা।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার প্রযুক্তির এসির মুল্য খুব বেশী হয় না। আর ব্র্যান্ডগুলো সবথেকে বেশী পরিমান নন-ইনভার্টার এসি উৎপাদন করার কারনে বাজারে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকে যার ফলে গ্রাহক অপেক্ষাকৃত কম প্রাইসেই এসি ব্যবহার করার সুবিধা পায় যেকারনে নন-ইনভার্টার এসির চাহিদাও অনেক বেশী।
বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার:
ইনভার্টার প্রযুক্তির এসিগুলোতে বিদ্যমান কম্প্রেসর গুলো সর্বদাই চালু থাকে যার কারনে হটাত করে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তি এই এসি ব্যবহার করে না। কেননা, কমপ্রেসর যদি বারবার।
চালু কিংবা বন্ধ হয় তাহলে বিদ্যুৎ এর উপর প্রভাব পরে বেশী। যার কারনে, নন-ইনভার্টগুলো অপেক্ষাকৃত কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন ধরুন, নবায়নযোগ্য শক্তি (সোলার সিস্টেম) ব্যবহার করে এই ধরনের এসি ব্যবহার করা যাবে।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার প্রজুক্তির এসিগুলোতে বিদ্যমান কম্প্রেসর তাপমাত্রা বিবেচনায় একটি নির্দিষ্ট লেভেল গিয়ে সরাসরি বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবার চালু হয়। যেহেতু কমপ্রেসর বারবার বন্ধ এবং চালু হতে থাকে মুলত এই কারনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পরে। মুলত এই কারনে নবায়নযোগ্য শক্তি (সোলার সিস্টেম) ব্যবহার করে এই ধরনের এসি ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
শীতলীকরণ শক্তি:
ইনভার্টার প্রযুক্তির এসিগুলো অপেক্ষাকৃত দ্রুত সময়ে রুমকে ঠাণ্ডা করতে সক্ষম হলেও ব্যবহার করার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এর কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে। ইনভার্টার প্রযুক্তিতে বিদ্যমান কম্প্রেসর কখনোই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়না। যেমন, আপনি যদি রুমের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রীতে নির্ধারণ করেন তাহলে এসি যখন এই লেভেলে তাপমাত্রা প্রদান করতে সক্ষম হবে তখনই কমপ্রেসর এর গতি কমে আসবে কিন্তু কমপ্রেসর এর কাজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হবেনা। আবার যখন রুমের তাপমাত্রা পূর্বের নির্ধারিত ২৩ ডিগ্রীর উপরে চলে আসবে তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমপ্রেসর এর গতি বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণ শক্তিতে রুমের ঠাণ্ডা করার কাজটি করবে। যেহেতু কম্প্রেসর কখনোই বন্ধ হয়না তাই দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে কম্প্রেসর এর উপর চাপ বাড়তে থাকে এবং এর কার্যকারিতাও হ্রাস পেতে থাকে।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার প্রযুক্তিতে আপনি যদি রুমের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রীতে নির্ধারণ করেন তাহলে এসি যখন এই লেভেলে পৌঁছাবে তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমপ্রেসর সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। আবার যখন রুমের তাপমাত্রা পূর্বের নির্ধারিত ২৩ ডিগ্রীর উপরে চলে আসবে তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্প্রেসর চালু হয়ে পূর্ণ শক্তিতে রুমের ঠাণ্ডা করার কাজটি করতে থাকবে। এই প্রক্রিয়ায় কম্প্রেসর এর উপর চাপ অপেক্ষাকৃত কম পরে যার কারনে নন-ইনভার্টার এসির শীতলীকরণ ক্ষমতাও দীর্ঘ মেয়াদে ভাল থাকে।
রিপেয়ারিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ:
ইনভার্টার এসির আরও একটি বড় আকারের সমস্যা হচ্ছে এর রিপেয়ারিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্য বেশী পরিমান অর্থ খরচ করতে হয়। যার কারনে, বেশী মুল্য দিয়ে এসি কেনার পর যদি কোনও কিছু রিপেয়ার করার প্রয়োজন হয় তাহলে বড় খরচের ধাক্কা সামাল দিতে হবে।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার এসি দামে যেমন সস্তা তেমনই এটিকে রিপেয়ারিং এবং রক্ষাবেক্ষন এর জন্য অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়না। এতে করে ব্যবহারকারী হিসাবে আপনার তেমন চিন্তাও নেই।
যন্ত্রাংশ:
ইনভার্টার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত এসিগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ যেমন, কম্প্রেসর, ক্যাপাসিটর, সার্কিট বোর্ড ইত্যাদির সহজলভ্য নয় কেননা এই প্রযুক্তির বয়স খুব বেশী দিন হয়নি। এই কারণে, যদি এসির কোনও কিছু খারাপ কিংবা নষ্ট হয় তাহলে সেগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। অন্যদিকে, এই যন্ত্রাংশগুলো যেহেতু সহজলভ্য নয় তাই এর মুল্যও অনেক বেশী।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার এসি হচ্ছে Toyota গারির মতন। অর্থাৎ, সহজেই পাওয়া যায় এবং খরচও কনেক কম।
মাসিক বিদ্যুৎ বিল:
ইনভার্টার এসি ব্যবহার করার সবথেকে বড় সুবিধা হচ্ছে, মাসিক বিদ্যুৎ বিল এর উপর এটির প্রভাব থাকে অনেক কম। ইনভার্টার প্রযুক্তিতে যেহেতু এসির কম্প্রেসর সম্পূর্ণরূপে কখনোই বন্ধ হয়না তাই বারবার কমপ্রেসর চালু হবার জন্য যেই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন সেটি রোধ করা যায়। এর ফলে আপনার মাসিক বিদ্যুৎ বিল এর পরিমানও আসবে কম।
অন্যদিকে, নন-ইনভার্টার এসি ব্যবহারের সবথেকে বড় অসুবিধা হচ্ছে, মাসিক বিদ্যুৎ বিল এর উপর এটির প্রভাব পরে অনেক বেশী। এই প্রযুক্তিতে কম্প্রেসর তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে বারবার চালু এবং বন্ধ হতে থাকে যার কারনে অতিরিক্তি বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজন হয়। এর ফলে আপনার মাসিক বিদ্যুৎ বিল এর পরিমান হবে কিছুটা বেশী।
এতক্ষণ আমরা ইনভার্টার এবং নন-ইনভার্টার এসির মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করছি উপরের বিষয়গুলো থেকে কিছুটা হলে বুঝতে পেরেছেন। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার প্রয়োজন বিবেচনায় কোন ধরনের এসি ব্যবহার করবেন? আপনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তাহলে নিচে আমাদের কিছু পরামর্শ থাকছে যেগুলো এসি নির্বাচনে আপনাকে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
পরামর্শ
- ইনভার্টার হচ্ছে নতুন প্রযুক্তির এসি যার কারনে এর মুল্য তুলানমূলক কিছুটা বেশী। এখন আপনি যদি এই ব্যয় বহন করতে পারেন তাহলে ইনভার্টার এসি আপনার জন্য ভালো পছন্দ হতে পারে। এছাড়াও, মনে রাখতে হবে এই এসির রিপেয়ারিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কিন্তু কিছুটা বেশী।
- যারা কিছুটা কম বাজেট এর মধ্যে এসি ব্যবহার করতে চান তারা চোখ বন্ধ করে নন-ইনভার্টার এসি ব্যবহার করতে পারেন। তবে লক্ষ্য রাখবেন, যেই মডেলের এসিটি আপনি কিনতে চান সেটি যাতে পুরাতন না হয়। কেননা, নতুন মডেলগুলো কিছুটা হলেও বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে সক্ষম।
- যেই রুমে এসি ইন্সটল করবেন সেই রুমে যদি একাধিক দরজা, জানালা থাকে কিংবা রুমের অবস্থান যদি সরাসরি ছাদের নিচে হয় কিংবা রুমের অবস্থান যদি এমন যেখানে অতিরিক্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করে তাহলে সবথেকে ভালো হবে নন-ইনভার্টার এসি।
- অনেকেই আছেন যারা বাসার ডাইনিং কিংবা ড্রয়িং রুমের জন্য এসি ব্যবহার করতে চান তবে এক্ষেত্রে সবসময় এই রুমগুলোতে এসি ব্যবহার হবেনা। ফ্যামিলির আড্ডা, দাওয়াত কিংবা ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই মুলত এসি ব্যবহার হবে তাহলে আপনার জন্য আদর্শ হচ্ছে নন-ইনভার্টার এসি।
- ইনভার্টার এসি থেকে বিদ্যুৎ সাশ্রয় তখনই হবে যখন সেটি দীর্ঘসময়ের জন্য চালু থাকবে। যেমন ধরুন, রাতে ঘুমানোর সময় যদি এসি ব্যবহার করেন তাহলে সেটি ৮-১০ ঘন্টা চালু থাকে এক্ষেত্রে, ইনভার্টার এসির ব্যবহার আপনার বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় করতে পারবে।
- অনেকেই আছেন যারা ব্যাকআপ বিদ্যুৎ শক্তি যেমন, আইপিএস কিংবা সোলার সিস্টেম ব্যবহার করে এসি ব্যবহার করার চিন্তা করছেন। এক্ষেত্রে, ইনভার্টার এসি ব্যতীত কোনও অপশন নেই।
- আপনি যে এড়িয়াতে থাকেন সেখানে যদি ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে ইনভার্টার এসি আপনার জন্য আবশ্যক। কেননা, নন-ইনভার্টার এসিগুলো খুব অল্প সময়ে বেশী পরিমান ঠাণ্ডা বাতাস প্রদান করতে পারে।
- আপনি যেই বাসায় এসি ইন্সটল করবেন সেখানে যদি বিদ্যুৎ শক্তির লেভেল উঠানামা করার প্রবণতা থাকে তাহলে কোনওভাবেই ইনভার্টার এসি ব্যবহার করবেননা। কেননা ইনভার্টার এসিতে ব্যবহৃত সার্কিট এবং যন্ত্রাংশগুলো অনেক বেশী সংবেদনশীল যা অনিয়মিত বিদ্যুৎ প্রবাহে খারাপ হবার ঝুঁকি অনেক বেশী থাকে।
- এছাড়াও, ইনভার্টার এসি যেই রুমে ব্যবহার করবেন, নিশ্চিত হয়ে নিবেন সেই রুমের ইন্স্যুলেশন ব্যবস্থা ভাল মানের রয়েছে। অর্থাৎ, এসি চালু থাকা অবস্থায় রুমের দরজা, জানালা থেকে শুরু করে যদি কোনও ফাক-ফোঁকর থাকে সেগুলোকেও ভালো করে বন্ধ করে নিতে হবে। অন্যথায়, দীর্ঘ মেয়াদে এসির স্থায়িত্ব হ্রাস পেতে থাকবে এবং বিদ্যুৎ বিলও আসবে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশী।
- কোনভাবেই ইনভার্টার এসি ওয়ারেন্টি কিংবা গ্যারান্টি ব্যাতিত ক্রয় করবেন না। যেহেতু এই এসিতে বিদ্যমান যন্ত্রাংশগুলোর মুল্য অনেক বেশী তাই আনঅফিসিয়াল প্রোডাক্ট ব্যবহার করা থেকে পরামর্শ দিচ্ছি।
আশা করছি, আর্টিকেলটি আপনার ভাল লেগেছে। যদি এই আর্টিকেল সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন কিংবা মতামত জানাতে চান তাহলে অনুগ্রহ করে নিচের কমেন্ট সেকশনে সেটি জানাতে পারেন। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে সর্বাত্মক সহায়তা করার।
খুব তথ্যবহুল লেখা। আপনাকে ধন্যবাদ।